পুঁজিবাজারে আবার কালো টাকা!


শেয়ারবাজারে আবার কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার। বাজারের স্থিতিশীলতার জন্য গঠিত ‘বাংলাদেশ ফান্ড’-এ বিনিয়োগ করলে টাকার উৎস নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা হবে না। সরকারকে ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করা যাবে।
রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে এ বিষয়টিসহ বাজারের স্বার্থে আরও কিছু প্রণোদনা চেয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সেগুলো যাচাই-বাছাই করে ইতিমধ্যে একটি সারসংক্ষেপ দাঁড় করিয়েছে বলে জানা গেছে। তবে বিষয়টি এখনো অর্থমন্ত্রীর অনুমোদনের অপেক্ষায়।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রণোদনাগুলোর সঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ ব্যাংক, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) ও আইসিবি জড়িত। তাই এদের সঙ্গে একটি বৈঠকে বসবে অর্থ মন্ত্রণালয়। ওই বৈঠকে বিষয়গুলো চূড়ান্ত করা হবে। গতকাল বুধবার পাঁচ দিনের সফরে ফ্রান্সে গেছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি দেশে ফেরার পরই বৈঠকটি ডাকা হবে।
আইসিবির প্রস্তাবে অবশ্য কালো টাকা সাদা করার কথা সরাসরি বলা হয়নি। বলা হয়েছে, চলতি ২০১০-১১ অর্থবছরের বাজেটে বাংলাদেশ ভৌত অবকাঠামো অর্থায়ন তহবিলে (বাংলাদেশ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফিন্যান্স ফান্ড—বিআইএফএফ) বিনিয়োগের মাধ্যমে যেভাবে অপ্রদর্শিত আয় সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছিল, বাংলাদেশ ফান্ডের ক্ষেত্রেও একইভাবে সুযোগ রাখা যেতে পারে।
২০১০-১১ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘বিআইএফএফে ইস্যুকৃত বন্ডে ২০১২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ১০ শতাংশ হারে কর প্রদান সাপেক্ষে বিনিয়োগের বিধান প্রবর্তন করা হবে।’ অর্থবিল ঘেঁটে দেখা যায়, এটি আসলে কালো টাকা সাদা করারই সুযোগ। কেননা, আয়কর অধ্যাদেশে ১৯সি নামে একটি ধারা সংযোজন করে বলা হয়েছে, বিআইএফএফে বিনিয়োগ করলে অর্থের উৎস সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করা হবে না।
বাংলাদেশ ফান্ডেও বিআইএফএফে বিনিয়োগের মতো অপ্রদর্শিত আয় বিনিয়োগের সুযোগ রাখা যেতে পারে বলে প্রস্তাব করা হয়েছে অর্থ বিভাগের সারসংক্ষেপে।
আইসিবির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা এ বিষয়ে জানান, কালো টাকা বলতে তাঁরা ‘অপ্রকাশিত টাকা’ বা অপ্রদর্শিত আয় বুঝিয়েছেন। অর্থাৎ যে আয় বৈধভাবে হয়েছে, কিন্তু কোনো কর দেওয়া হয়নি। তবে, অবৈধভাবে অর্জিত আয় যেমন কালোবাজারি, চোরাচালান, ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে আয় করা টাকার কথা বলা হয়নি।
বাংলাদেশ ফান্ড নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় আরও বলেছে, ‘বাজারে আসার জন্য অপেক্ষমাণ সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের ১০ শতাংশ অভিহিত মূল্যে (ফেস ভ্যালু) বাংলাদেশ ফান্ডকে দেওয়া হবে। এ ছাড়া ভবিষ্যতে যেসব কোম্পানি প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে বাজারে শেয়ার ছাড়বে, সেসব কোম্পানিকে যে পরিমাণ মূলধন বাজার থেকে সংগ্রহ করা হবে, তার ৫ শতাংশ শেয়ার বাংলাদেশ ফান্ডের জন্য বরাদ্দ রাখতে হবে। ফান্ডের লভ্যাংশ থাকবে সম্পূর্ণ করমুক্ত। এতে সরকারের কোনো সংশ্লেষ থাকবে না। সরকার শুধু নীতিগত সমর্থন দেবে।’
যোগাযোগ করা হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কালো টাকা বা অপ্রদর্শিত টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া নীতিগতভাবে সমর্থনযোগ্য নয়। আর প্রস্তাবিত বাংলাদেশ ফান্ডের ইউনিট কেনায় যদি অধিক মাত্রায় অপ্রদর্শিত আয় ধাবিত হয়, চূড়ান্ত অর্থে তা ঠিক হবে কি না, ভাবার বিষয়।’
তবে বাংলাদেশ ফান্ডের জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বা নতুন আইপিওর প্রস্তাবিত অংশ বরাদ্দ রাখা যেতে পারে বলে মির্জ্জা আজিজুল মনে করেন।
ডিএসইর সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক সালাহউদ্দিন আহমেদ খান প্রথম আলোকে বলেন, এ ফান্ডে অপ্রদর্শিত আয় বা কালো টাকার বিষয়টি না জড়ানোই ভালো হবে। বরং এ মুহূর্তে ঘোষিত ফান্ডটি দ্রুত কার্যকর করা জরুরি।
একই রকম অভিমত ব্যক্ত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, কালো টাকাকে এভাবে বাজারে ঢুকতে দেওয়া ঠিক হবে না।
উল্লেখ্য, এর আগে সর্বশেষ গত ২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেটে ১০ শতাংশ কর দিয়ে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা হলে তা কোনো প্রশ্ন ছাড়াই গ্রহণ করার সুযোগ দেওয়া হয়। অর্থাৎ এই প্রক্রিয়ায় শেয়ারবাজারে কালো টাকা বিনিয়োগ করে তা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়।
অন্যান্য প্রণোদনা: বাংলাদেশ ফান্ডকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি থেকে কিছুটা ছাড় দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে এতে। যেহেতু ফান্ডের একটা অংশ মুদ্রাবাজারে বিনিয়োগ করা হবে, তাই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ওপর আরোপিত নিয়মকানুন এ ফান্ডের ক্ষেত্রে শিথিল করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এ ছাড়া বাংলাদেশ ফান্ডের ইউনিট সার্টিফিকেটকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেন অনুমোদিত সিকিউরিটিজ হিসেবে বিবেচনা করে, সে কথাও বলা হয়েছে। এতে ফান্ডটি খুবই আকর্ষণীয় হবে বলে মনে করছে আইসিবি।
উল্লেখ্য, ৬ মার্চ পাঁচ হাজার কোটি টাকার ‘ওপেন এন্ড’ বা মেয়াদহীন মিউচুয়াল ফান্ড গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। বলা হয়, আইসিবি, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চার ব্যাংক (সোনালী, রূপালী, অগ্রণী ও জনতা), জীবন বীমা করপোরেশন, সাধারণ বীমা করপোরেশন এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডের (বিডিবিএল) যৌথ উদ্যোগে ফান্ডটি গঠিত হবে। ইতিমধ্যে সাত প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগই তাদের পর্ষদে এ ফান্ডে বিনিয়োগের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর এসইসির কাছেও অনুমোদন চেয়ে তহবিল গঠনের প্রস্তাব জমা দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, মূল উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান আইসিবি জোগান দেবে ফান্ডের ১০ শতাংশ অর্থাৎ ৫০০ কোটি টাকা। তবে মেয়াদহীন হওয়ায় ভবিষ্যতে আকার বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। বেসরকারি ব্যাংক ও অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো চাইলে এ তহবিলে অংশ নিতে পারবে।
যোগাযোগ করলে আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফায়েকুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, পুঁজিবাজারের স্বার্থে সরকারের কাছে কিছু প্রণোদনা চাওয়া হয়েছে। সরকার তা অনুমোদন দেবে বলে তিনি আশাবাদী। এর বাইরে কোনো মন্তব্য করতে সম্মত নন তিনি।
এদিকে বাংলাদেশ ফান্ডের জন্য যে ৫০০ কোটি টাকার সংস্থান করা হবে, তা পুষিয়ে নিতে নিজস্ব মূলধন বাড়াতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে গত মাসে আবেদন করে আইসিবি। তিন সপ্তাহ আগে অর্থমন্ত্রী এতে সম্মতি দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, মিউচুয়াল ফান্ড এমন একটি তহবিল যা প্রধানত শেয়ার, বন্ড বা এ জাতীয় উপকরণে বিনিয়োগের লক্ষ্যে গঠিত হয়ে থাকে। বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অর্থ নিয়েই এ ফান্ড গঠন করা হয়। আর অর্থের জোগানদাতারা বিনিয়োগের বিপরীতে অর্জিত মুনাফা থেকে অর্থের অনুপাত অনুযায়ী লভ্যাংশ পেয়ে থাকেন।
দেশীয় বাজারে বর্তমানে মেয়াদি (ক্লোজ এন্ড) ও মেয়াদহীন (ওপেন এন্ড) দুই ধরনের মিউচুয়াল ফান্ডই রয়েছে। মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডগুলো স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হলেও মেয়াদহীন ফান্ডগুলো তালিকাভুক্তির বাইরে। সরকারি ও বেসরকারি খাতে বর্তমানে চারটি মেয়াদহীন মিউচুয়াল ফান্ড রয়েছে। আর তালিকাভুক্ত মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ড রয়েছে ৩৩টি।

This entry was posted in News (খবর) on by .

About Emani

I am a professional Graphic designers create visual concepts, by hand or using computer software, to communicate ideas that inspire, inform, or captivate consumers. I can develop overall layout and production design for advertisements, brochures, magazines, and corporate reports.

Leave a comment