টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর দেড় যুগে অনেকবারই শ্রীলঙ্কা সফরে গেছে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কাও এসেছে বাংলাদেশে। তবে টেস্টে কখনই লঙ্কানদের হারাতে পারেনি লাল-সবুজের দল। দেশের মাটিতে অদম্য, কিন্তু বিদেশে? বিশ্বের বড় বড় দলগুলোর সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্য দেশের বাইরে লড়াই দেখাতে হবে, সামর্থ্যের প্রমাণ দিতে হবে বিদেশেও ভালো খেলে-ক্রিকেট বিশ্লেষকরা এমন মন্তব্য প্রায়ই করেছেন গত কয়েক বছরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দারুণ কয়েকটি সাফল্যের স্বাক্ষর রাখা বাংলাদেশকে নিয়ে। এবার নিজেদের যোগ্যতা দেখিয়ে দিল মুশফিকরা, শ্রীলঙ্কার মাটিতে শততম টেস্ট জিতে। কলম্বোতে শততম টেস্টে শ্রীলঙ্কাকে চার উইকেটে হারাল বাংলাদেশ। এই জয়ে হেরাথদের সঙ্গে সিরিজটা ভাগাভাগি করে নিলেন মুশফিকরা।
৪ উইকেটে ম্যাচ জয়ের পর সাকিব আল হাসান দৃঢ়চেতা কণ্ঠে জানালেন, বিদেশের মাটিতে ভালো করতে চায় বাংলাদেশ। এ ধারাবাহিকতা ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ দলের সামনে, ‘শ্রীলঙ্কায় টেস্ট জিতে খুব ভালো লাগছে। শততম টেস্টে এর চেয়ে ভালো কী হতে পারে। যেভাবে আমরা উন্নতি করছি ভবিষ্যতে আরও ম্যাচ জিতব। দেশে আমাদের খুবই ভালো সময় যাচ্ছে। কিন্তু দেশের বাইরেও আমরা ভালো করতে পারি।’ ভবিষ্যতে প্রতিপক্ষদের মাঠে বাংলাদেশ হয়তো আরও সমীহ পাবে, যার শুরুটা হয়েছে কয়েক বছর আগে।
শ্রীলঙ্কার উদ্দেশে দেশ ছাড়ার আগেই শততম টেস্ট খেলার রোমাঞ্চ কাজ করছিল বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের মনে। ভালো কিছু করতে মরিয়া ছিল তারা। কিন্তু শুরুটা হয়নি মনের মতো। গলে প্রথম টেস্টে অসহায় আত্মসমর্পণ করে ২৫৯ রানে হেরেছিল বাংলাদেশ। এরপর এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। নানা উপহার ও আয়োজন দিয়ে জমকালো করা হলো টাইগারদের শততম টেস্টের মঞ্চ।
কিন্তু কলম্বোর ‘অপয়া’ পি সারা ওভালের স্মৃতি যেন মুশফিকদের মনে খানিকটা খচখচ করছিল। আগের তিনটি ম্যাচ হয়েছিল এই মাঠে, যেখানে সবগুলোই ইনিংস ব্যবধানে হেরেছিল তারা। তবে সবার মনে অস্বস্তি থাকার কথা নয়, কারণ মুশফিক ছাড়া আর সবাই প্রথমবার এ মাঠে নামার অপেক্ষায় ছিলেন। ওই ‘দুঃসহ’ স্মৃতি আসলে মনে ঠাঁই না পাওয়ার আরেকটি কারণ ছিল-সবাই বাংলাদেশের শততম টেস্টের অংশীদার হবেন বলে।
আর ‘সেঞ্চুরি’ টেস্টের রোমাঞ্চই যেন বাংলাদেশকে ইতিহাস গড়ার অনুপ্রেরণা দিল। শুরু থেকেই যুদ্ধাংদেহী ছিলেন মুশফিক-তামিমরা। শততম টেস্টের আগের দিন মুশফিক তার অনুভূতি ভাগাভাগি করেছিলেন এভাবে, ‘অধিনায়ক হিসেবে এই ম্যাচ খেলতে পারাটা আমার জন্য বিরাট ব্যাপার। বিকেএসপিতে বসেই খেলা দেখেছিলাম। খেলা দেখতে দেখতে ভাবছিলাম যদি কখনও জাতীয় দলের হয়ে টেস্ট খেলতে পারি। বিশ্বাসটা ওখান থেকে জন্ম নিয়েছিল। স্বপ্নটা তখন থেকেই। এই ম্যাচটি নিয়ে আমি রোমাঞ্চিত। দলের সবাই প্রস্তুত, ভালো কিছু করে শততম জয় উদযাপন করতে।’ অধিনায়কের স্বপ্নকে সবাই একসঙ্গে সত্যি করেছেন, হয়েছেন গর্বিত দলের সদস্য।
শ্রীলঙ্কার মাটিতে এ জয়ের পরও সিরিজ হাতে নিতে পারেনি বাংলাদেশ। ‘জয় বাংলা কাপ’ ভাগাভাগি করতে হয়েছে তাদের। কিন্তু এক ম্যাচেই অনেক প্রাপ্তি তাদের। কলম্বোর অজেয় ভেন্যু জয় করেছে তারা দাপটের সঙ্গে। সেখানে ব্যাটিং-বোলিংয়ে সবাই ছিলেন অসাধারণ। কেউ না কেউ দাঁড়িয়ে গেছেন। একটি দল হিসেবে যে সফল হওয়া যায়, তার প্রমাণই মিলেছে পি সারা ওভালে।
প্রথম ও দ্বিতীয় দিনের শেষ বিকালে যা একটু বিপদের মুখোমুখি হয়েছিল তারা। কিন্তু ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ বেশিরভাগ ছিল টাইগারদের হাতে।
প্রথম ইনিংসে শ্রীলঙ্কাকে খাদের কিনারায় রেখেছিল বাংলাদেশের বোলাররা। দিনেশ চান্ডিমাল না থাকলে লঙ্কানদের খাদেই পড়ে যেতে হতো। এ টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানের ১৩৮ রানের সুবাদে প্রথম ইনিংসে স্বাগতিকরা ৩৩৮ রান করেছিল। অথচ ১৯৫ রানেই ৭ উইকেট হারিয়েছিল তারা। সেখান থেকেই ধীরে-সুস্থে এক ইনিংস খেলে শ্রীলঙ্কাকে টেনে তোলেন চান্ডিমাল।
স্বাগতিকদের তিন শতাধিক রানের ইনিংসের জবাবে ব্যাটিংয়েও দারুণ করেছিল বাংলাদেশ। তামিম ইকবাল ও সৌম্য সরকারের ৯৫ রানের উদ্বোধনী জুটিতে বড় লিড নেওয়ার আভাস দিয়েছিল তারা। তামিম হাফসেঞ্চুরি থেকে ১ রান দূরে থাকতে আউট হন। সৌম্য করেছিলেন টানা দ্বিতীয় হাফসেঞ্চুরি। শ্রীলঙ্কার মাটিতে এ ওপেনার চার ইনিংসের তিনটিতেই পেয়েছেন পঞ্চাশের দেখা।
কিন্তু দ্বিতীয় দিনের শেষ সেশনে আসেলা গুনারত্নের বোলিংয়ে কাবু হয়ে পড়ে বাংলাদেশ। ৬ রানের ব্যবধানে ৩ উইকেট হারিয়ে বিপদে পড়েছিল তারা। মাত্র ১৯৮ রানে ৫ উইকেট হারায় সফরকারীরা। সেখান থেকে তৃতীয় দিন দলকে টেনে তোলেন মুশফিকুর রহিম ও সাকিব আল হাসান।
দুই অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যানের ইনিংসের সুবাদে তৃতীয় দিন ভালো খেলেছিল তারা। মুশফিক হাফসেঞ্চুরি করে আউট হলেও সাকিবকে উপযুক্ত সঙ্গ দেন অভিষেকে খেলতে নামা মোসাদ্দেক হোসেন। শততম টেস্টে অভিষিক্ত হয়ে হাফসেঞ্চুরি করে সেরা ইনিংস খেলেন তিনি।
সাকিব (১১৬) ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে পান সেঞ্চুরি। একটি সেঞ্চুরি ও তিনটি হাফসেঞ্চুরিতে ৪৬৭ রান করে বাংলাদেশ। প্রথম ইনিংসে শ্রীলঙ্কার চেয়ে ১২৯ রানে এগিয়ে থেকে ইনিংস শেষ করে সফরকারীরা। এটাই বিদেশের মাটিতে প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ লিড। যাতে চতুর্থ দিনও দাপট দেখাতে পেরেছে মুশফিকরা।
যার ফলে শ্রীলঙ্কাকে দ্বিতীয় ইনিংসে খুব বেশি সুবিধা করতে দেয়নি বাংলাদেশ। চতুর্থ দিন প্রথম সেশনে উপুল থারাঙ্গার উইকেটই ছিল একমাত্র প্রাপ্তি। এরপর দ্বিতীয় সেশনে দৃঢ়চেতা লঙ্কান ব্যাটিং লাইনআপ ভেঙে দেয় সাকিব ও মুস্তাফিজরা। সাকিবের ঘূর্ণি ও মুস্তাফিজের পেসে কিছু বুঝে উঠার আগে সাজঘরে আসা-যাওয়ার মিছিলে যোগ দেয় স্বাগতিক ব্যাটসম্যানরা।
দ্বিতীয় ইনিংসে দিমুথ করুণারত্নের সেঞ্চুরি না হলে ব্যাটিং লজ্জার মুখেই পড়তে পারত লঙ্কানরা। শেষ পর্যন্ত তার ১২৬ রানের ওপর ভর দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে স্বাগতিকরা। শেষ বিকালে তাকে ফিরিয়ে কিছুটা স্বস্তি দিয়েছেন সাকিব। ৮ উইকেটে ২৬৮ রানে চতুর্থ দিন শেষ করে তারা দিলরুয়ান পেরেরার প্রতিরোধে। তবে নবম উইকেটে ৮০ রানের জুটিতে তিন’শর উপর দলীয় সংগ্রহ করতে পারে শ্রীলঙ্কা। প্রথম সেশনের প্রথম ঘণ্টাতে পেরেরা ও লাকমল আউট হলে ৩১৯ রানে গুটিয়ে যায় হেরাথের দল। বাংলাদেশের লক্ষ্য দাঁড়ায় ১৯১ রানের।
ইতিহাস গড়ার পথে সেই লক্ষ্যকে টপকে যেতে খুব বেশি সমস্যা হয়নি তামিম-মুশফিকদের। দ্রুত ২ উইকেট পড়ে গেলেও তামিমের হাফসেঞ্চুরিতে লঙ্কা জয়ের স্বপ্ন পূরণ হয়। লক্ষ্য ২০০’র নিচে হলেও সাবধানে ব্যাট করে গেছেন সবাই। তবে সাব্বির ও তামিমের জুটিই ভিত গড়ে দিয়েছিল। তাদের তৈরি করা পথে মুশফিক ও মেহেদী হাসান মিরাজ অবিচ্ছিন্ন থেকে দলকে নেন জয়ের বন্দরে।
নিজেদের টেস্ট ইতিহাসে এর আগে বিদেশে জেতার অভিজ্ঞতা হয়েছিল বাংলাদেশের মাত্র দুইবার। প্রথমবার ৮ বছর আগে, ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে তাদের মাঠে হোয়াইটওয়াশ করেছিল বাংলাদেশ। আর সর্বশেষ জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ২০১৩ সালে, দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজ ড্র করেছিল শেষটি জিতে। দেশের মাটিতে গত কয়েক বছর ধরে দাপট দেখানো বাংলাদেশ এবার লঙ্কা জয় করে বিদেশি দলগুলোকে একরকম সতর্ক করে দিল। একই সঙ্গে দেখিয়ে দিল-তাদের ক্রিকেট সঠিক পথেই চলছে।
শততম টেস্টে বাংলাদেশের লঙ্কা জয়
Advertisements